কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে এই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে বিদেশী প্রজাতির লাল রঙের আঙ্গুরের চাষাবাদ করে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছেন কৃষি উদ্যোক্তা হাসেম আলী। তিনি ইউটিউব দেখে দুই বিঘা আবাদী (কৃষি) জমিতে টানা দেড় বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিদেশী প্রজাতির আঙ্গুরের চাষাবাদ করে সফলতা দেখছেন। স্থানীয় বাজারে ব্যাপক চাহিদা ও ভালো দাম থাকায় অধিক লাভের আশা করছেন কৃষি উদ্যোক্ত হাসেম আলী।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ফুলবাড়ী উপজেলা সদর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার উত্তরে সীমান্ত ঘেঁষা কাশিপুর ইউনিয়নের আজোয়াটারী এলাকার কৃষি উদ্যেক্তা হাসেম আলী অনেক স্বপ্ন নিয়ে দুই বিঘা সমতল জমিতে বাণিজ্যিকভাবে বিদেশী প্রজাতির আঙ্গুরের চাষাবাদ করে। টানা দুই বছর আঙ্গুরের পরিচর্চা করে সফলতা এনেছেন তিনি। এখন তার বাগানে ২০০ থেকে ২৫০ টি আঙ্গুরের গাছ সবুজে ভরে গেছে চারিদিক। প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৪০ টি আঙ্গুর গাছে ফলন আশায় এলাকায় ব্যাপক চমক সৃষ্টি করেছেন। ফলে প্রতিদিন উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষজন আঙ্গুরের বাগান দেখতে ভিড় করছেন। জেলা-উপজেলা জুড়ে কমলা, মাল্টাসহ বিভিন্ন ফলের বাগান থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে এই আঙ্গুরের বাগানটি এই প্রথম কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায়। এই অঞ্চলের মাটিতে আঙ্গুরের চাষাবাদের উপযোগী হওয়ায় সফল কৃষি উদ্যোক্তা হাসেম আলীর আঙ্গুর বাগানের সফলতা দেখে অনেকেই তার বাগান থেকে ৩০ থেকে ৪০ প্রকার জাতের আঙ্গুরের চারা সংগ্রহ করে আঙ্গুর বাগান করতে উৎসাহী হচ্ছেন।
কৃষি উদ্যোক্তা হাসেম আলী জানান, কিভাবে আঙ্গুরের চাষাবাদ করে সেটি ইউটিউবে দেখে আমার এক সহযোদ্ধা ব্যাংক কর্মকর্তা রুহুল আমিন আমাকে সহযোগীতা করেন। তার মাধ্যমেই রাশিয়া ও ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাইকুনর, গ্রীনলং, একেলো, এনজেলিকাসহ প্রায় ৩০ প্রজাতির উন্নত জাতের আঙ্গুরের চারা সংগ্রহ করে দুই বছর আগে দুই বিঘা জমিতে বড় বড় টপের মাধ্যমে চাষাবাদ করেছি। তবে আঙ্গুরের বাগান দেওয়ায় এলাকার মানুষজন হাসি-তামাশা করতো। কোন ভাবেই এই মাটিতে আঙ্গুরের চাষ হবে। তবে কখনও হতাশ হয়নি। আমার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়েছি। গত বছর কয়েকটি গাছে ফলন আশায় আমার কাছে কিছুটা বিশ্বাস এসেছে, যে আমার স্বপ্ন পুরণ হতে চলছে। আল্লাহের অশেষ কৃপায় এ বছর প্রায় ৪০ টি গাছের থোঁকায় থোঁকায় আঙ্গুর ধরায় আমার মন ভরে গেছে। আমিও কোন ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে এভাবে গাছে গাছে ফলন আসবে। সব বাঁধা পেরিয়ে ৩০০ টাকা কেজি দরে দেড় মন আঙ্গুর বিক্রি করতে পেরেছি। কয়েকদিনের মধ্যে আরও দেড় মন আঙ্গুর বিক্রি করতে পারবো। এ পর্যন্ত আঙ্গুর চাষে খরচ হয়েছে প্রায় ১২ লাখ টাকা। দেড় মন আঙ্গুর ও বিভিন্ন জাতের আঙ্গুরের চারা বিক্রি করে এযাবদ পর্যন্ত ৫ লাখ টাকা এসেছে। প্রতিদিন শতশত আঙ্গুরের চারা ৩০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টায় পিস বিক্রি করেছেন তিনি। এছাড়াও স্থানীয়রা সহ যারা আমার বাগানের আঙ্গুর দেখতে এসেছেন তারাও আঙ্গুর খেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন। আগামী বছর সবগুলো গাছে আঙ্গুর আসলে তা ফুলবাড়ী উজেলাসহ জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে বলে আমার বিশ্বাস।
স্থানীয় প্রভাষক শংকর সেন ও আব্দুল হামিদ জানান, আমরা যখন শুনেছি কৃষি উদ্যোক্তা হাসেম আলী দুই বিঘা আবাদী জমিতে বাণিজ্যিকভাবে আঙ্গুর রোপন করেছে। তখন আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হয়েছে। কারণ আমরা কোনদিনও ভাবিনি যে এই সমতল জমিতে আঙ্গুরের চাষাবাদ হবে। এই আবাদী জমিতে আঙ্গুরের চাষ করে হাসেম আলী এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। লাল রঙের আঙ্গুর চাষ করে উপজেলা তথা কুড়িগ্রাম জেলা জুড়ে ব্যাপক চমক সৃষ্টি করেছেন। তার বাগানের আঙ্গুর খেতে খুবই সু-মধুর। বাজারের আঙ্গুরের চেয়েও খুবই সু-স্বাস। আমরা তার সাফল্যকে স্বাগত জানাই।
লালমনিরহাট জেলা সদর থেকে আঙ্গুরের বাগান দেখতে দর্শনার্থী এস দিলীপ রায় জানান, ফেসবুকে আঙ্গুরের বাগান দেখে বাস্তবে কৃষি উদ্যোক্তা হাসেম আলীর আঙ্গুরের বাগান দেখতে এসেছি। আবাদী জমিতে এরকম সুন্দর একটি আঙ্গুরের বাগান দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছে। সেই সাথে ক্ষেতের তাজা আঙ্গুর খেয়ে দেখলাম খুবই মিষ্টি ও সু-স্বাদ। তিনি আরও জানান, আমার জানা মতে উত্তরঞ্চলের কোন জেলায় বাণিজ্যিকভাবে আঙ্গুরের চাষাবাদ নেই। এটি কুড়িগ্রাম জেলাসহ উত্তরঞ্চলের প্রথম আঙ্গুরের বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ। এই আঙ্গুরের বাগানটি উত্তরঞ্চলের মানুষের মনে অনুপ্রেরণা জোগাবে বলে আমার বিশ্বাস ।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছা: নিলুফা ইয়াছমিন জানান, এই কৃষি উদ্যোক্তা হাসেম আলী আবাদী জমিতে আঙ্গুরের চাষাবাদ করে ফুলবাড়ীসহ কুড়িগ্রাম জেলা জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। আবাদী জমি হলেও বেলে-দোঁয়াশ মাটি হওয়ায় আঙ্গুরের ফলন ও খেতে সু-স্বাস হয়েছে। এই প্রথম এই ফুলবাড়ী উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে আঙ্গুর চাষ করায় অনেকেই এক নজর দেখার জন্য ছুটছেন ওই উদ্যোক্তার পাশে। অনেকেই তার কাছে বিভিন্ন জাতের আঙ্গুরের চারা সংগ্রহ করে আঙ্গুরের বাগান লাগাচ্ছেন। জেলা-উপজেলা কৃষিবিভাগ পাশে থেকে কৃষি উদ্যোক্তা হাসেম আলীসহ যে সকল চাষি আঙ্গুরের চাষ করেছেন তাদেরকে সব ধরণের সহযোগীতা করা হবে। তিনি আরও জানান, এখন থেকে বেকার যুবক-যুবতিরা চাকরির পেছনে না ছুটে নিজেরাই উদ্যোক্তা হলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে আর্থিকভাবেও সচ্ছলতা ফিরে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।