সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে স্কুলছাত্রী হুমায়রা আক্তার মুন্নি খুনের আলোচিত মামলার প্রধান আসামি সেই বখাটে ইয়াহিয়া সর্দারকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বুধবার দিনগত রাত ১টার দিকে মহানগরীর জালালাবাদ থানার মাসুক বাজার এলাকার দরশা গ্রামের একটি বাড়ি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে গ্রেপ্তারে তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নেয়া হয়।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পুলিশ সুপার মো. বরকতুল্লাহ খান। পরে সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করা হয় ইয়াহিয়াকে।
পুলিশ সুপার জানান, মুন্নি হত্যার পর সুনামগঞ্জ জেলা পুলিশের পাঁচটি দল ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তারে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায়।
গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্ব দেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ, বেলায়েত শিকদার, দিরাই থানার ওসি মোস্তফা কামাল।
উল্লেখ্য, গত ১৬ ডিসেম্বর রাতে দিরাই পৌরসভার আনোয়ারপুর গ্রামের মদনী মহল্লা এলাকায় বাসায় ঢুকে ছুরিকাঘাত করে দশম শ্রেণির ছাত্রী হুমায়রা আক্তার মুন্নিকে খুন করে তার কথিত প্রেমিক ইয়াহিয়া সর্দার।
এ ঘটনায় মুন্নির মা বাদী হয়ে ইয়াহিয়াসহ দুজনকে আসামি করে দিরাই থানায় মামলা করেন।
ঘটনার পাঁচ দিনের মাথায় আলোচিত এ খুনের প্রধান আসামিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর আগে অপর আসামি তানভীরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ঘোষণা দিয়েই হুমায়রা আক্তার মুন্নীকে হত্যা করলেন বখাটে ইয়াহিয়া (২২)। প্রেমের প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে দিনের পর দিন হুমায়রাকে উত্ত্যক্ত করছিলেন ইয়াহিয়া। এরপর গত শনিবার রাতে ঘরে ঢুকে পড়ার টেবিলেই তাকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান ইয়াহিয়া। হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে।
হুমায়রা ছিল দিরাই বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী। মা রাহেলা বেগম ও ছোট ভাই মাহিদ আহমদের (৮) সঙ্গে থাকত সুনামগঞ্জের দিরাই পৌর শহরের মাদানী মহল্লার ভাড়া বাসায়। হুমায়রার বাবা ইতালিতে আছেন ছয় বছর ধরে। দিরাইয়ের কুলঞ্জ ইউনিয়নের নদগীপুরে তাঁদের গ্রামের বাড়ি। আর বখাটে ইয়াহিয়ার বাড়ি করিমপুর ইউনিয়নের সাকিতপুর গ্রামে। সপরিবারে তাঁরা আত্মগোপন করেছেন।
পুলিশ, হুমায়রার স্বজন, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বছর ধরেই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসার সময় হুমায়রাকে উত্ত্যক্ত করছিলেন ইয়াহিয়া। পরিবার বিষয়টি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানালে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ও প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতিতে গত ২৬ অক্টোবর দুই পরিবারের লোকদের নিয়ে বিদ্যালয়ে বৈঠক হয়। সেখানে হুমায়রাকে আর উত্ত্যক্ত করবেন না বলে ইয়াহিয়া লিখিত মুচলেকা দেন। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে আবার তাকে উত্ত্যক্ত করছিলেন তিনি।
দিরাই বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জাফর ইকবাল বলেন, ইয়াহিয়া আর কখনো এ কাজ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করে যায়। আমরাও মনে করেছিলাম সে এ পথ থেকে সরে যাবে। কিন্তু এ রকম জঘন্য কাজ করে বসল।
হুমায়রার মামা মাহমুদুল হাসান বলেন, গত বুধবার বিকেলে বাড়ির সামনে এসে ইয়াহিয়া হুমায়রাকে ডাকতে থাকে। চিৎকার করে বলে, তোকে মারব, আমিও মরব। কিন্তু এ বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়নি।
ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু হেনা বলেন, আমাদের আশা ছিল, হুমায়রা এসএসসিতেও ভালো ফল করবে। আমরা ইয়াহিয়ার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
প্রাথমিকে বৃত্তি পাওয়া হুমায়রা জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিল। আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষায় বসার কথা ছিল তার। স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হবে। সে জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছিল বিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্রী হুমায়রা আক্তার।
ইতালিপ্রবাসী বাবা হিফজুর রহমান মেয়ের পড়ার সুবিধার জন্য দুর্গম হাওরের গ্রাম থেকে পরিবারকে দিরাই সদরে বাসা ভাড়া করে দিয়েছেন। কিন্তু মা-বাবার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে বখাটে ইয়াহিয়ার ছুরিকাঘাতে।
রবিবার সকালে দিরাই পৌর শহরে হুমায়রাদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ভিড়। দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকে হুমায়রার পরিবার। একই তলায় আরও দুটি পরিবার ভাড়া থাকে। নিচতলায় থাকে দুটি পরিবার।
শনিবার ঘটনার সময় ভাড়াটেরা কেউই বাসায় ছিলেন না। হুমায়রাদের বাসায় দুটি শয়নকক্ষ। সামনের কক্ষে সাদা টাইলসের মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। সাক্ষ্য দিচ্ছে শনিবার রাতের ঘটনার। ওই কক্ষেই ছোট ভাইকে নিয়ে থাকত হুমায়রা। বিছানার পাশে তার পড়ার টেবিল। টেবিলে এলোমেলো পড়ে আছে তার বইগুলো।
হুমায়রার ফুফাতো ভাই সৌরভ আহমদ বলেন, শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে হুমায়রা তার ঘরে পড়ছিল। মা রাহেলা বেগম পাশের ঘরে ছিলেন। ইয়াহিয়া প্রথমে রাহেলা বেগমের ঘরে গিয়ে হুমায়রাকে খোঁজেন। তাকে দেখে রাহেলা বেগম দাঁড়াতেই তাঁকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দেন তিনি। পরে হুমায়রার ঘরে ঢুকেই তাকে চেয়ারে চেপে ধরে পেটে ছুরিকাঘাত করেন। রাহেলা বেগম দৌড়ে আসেন মেয়ের ঘরে। হুমায়রা চিৎকার করে উঠলে ইয়াহিয়া তার বুকে ছুরি মেরে পালিয়ে যান।
ঘটনার পর থেকে আহাজারি করছেন রাহেলা বেগম। স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। রাহেলা বলছিলেন, আমি আমার সোনার টুকরা মেয়েরে চাই। তোমরা আমার মেয়েরে আইন্যা দেও। আমি তারে বাঁচাইতাম পারলাম না। তার বাবারে আমি কী জবাব দিমু। সৌরভ বলেন, মেয়ের এমন মৃত্যুর খবর পেয়ে ইতালিতে হুমায়রার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
ইয়াহিয়াকে দেখা যেত ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে
দিরাই পৌর শহরের ১৫-২০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসএসসি পরীক্ষা দিলেও ইয়াহিয়া পাস করেননি। বছরখানেক আগে দিরাই শহরের সেন মার্কেটের একটি কাপড়ের দোকানে কাজ নেন। তবে এখন বেকার। শহরে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাঁকে দেখা যেত।
ছাত্রলীগের দিরাই উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মো. উজ্জ্বল মিয়া বলেন, ‘ইয়াহিয়া ছাত্রলীগের কোনো নেতা নয়। সে কোনো কমিটিতেও নেই। তবে মাঝেমধ্যে মিছিল-মিটিংয়ে থাকত।